ঢাকা , মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫ , ৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​তরমুজে বাণিজ্য ৪০ হাজার কোটি!

সিজনাল নয়, আগাম তরমুজে ভরপুর বাজার

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ১৭-০৩-২০২৫ ০৫:০৩:৪০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৭-০৩-২০২৫ ০৭:১৪:৩২ অপরাহ্ন
সিজনাল নয়, আগাম তরমুজে ভরপুর বাজার ​ছবি: সংগৃহীত
বিকেল নামতেই একের পর এক তরমুজবোঝাই ট্রলার ভিড়তে শুরু করে মুশুরীকাঠি ঘাটে। তরমুজ নিতে তীরে অপেক্ষা করে শত শত ট্রাক। পাইকারি ক্রেতার সঙ্গে দরদামে কৃষকের বনিবনা হলে ট্রলারের গলুইতে নেমে আসেন শ্রমিক। কোনটিতে পাঁচজন, কোনটিতে ১০ জন। তার বেশিও দরকার পরে কোনো কোনো ট্রলারে। মুহূর্তে কথাবার্তা, গান, হাসি-ঠাট্টায় সরগরম হয়ে ওঠে চারপাশ। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার ফেরীঘাট থেকে আমখোলা ইউনিয়ন নদী ধরে হরিদেপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এমন চিত্রে চোখ আটকে যাবে। গ্রীষ্ম মৌসুমে এভাবেই থাকে বলে জানালেন মুশুরিকাঠির ঘাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা।

‘তয় এই সিজনে মানসের আনাগোনা বেশি। এবার তো তরমুজের ব্যমালা (অধিক) ফলন হইছে। দুপুরের পর থেইকা তরমুজ লোড-আনলোড শুরু হয়। রাইত ৯টা-১০টা বাইজ্জা যায়।’ চায়ের কাপে চিনি দিতে দিতে বলেন তিনি।গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, ‘সিজনাল তরমুজ এহনো ওডে নাই। আগাম তরমুজ আইছে। গ্রেট ওয়ান, ফ্যামিলি, আনন্দ, লাকি, ড্রাগন আরও কি কি নাম কইলো চরের মানসে। অত নাম মনে রাখতে পারি না।’ তারপরই বলে ওঠেন, ‘তরমুজতো তরমুজই। তরমুজ আবার ড্রাগন হইবে কেন? দুনিয়ায় কিচ্ছু বাদ নাই সব জিনিসে হাইব্রিড।’ চা দোকানি মোস্তফার রোজগারও ভালো। তরমুজের মৌসুমে হাজার-বারোশ টাকা লাভ থাকে বলেও আলাপ করতে করতে জানান।

শুধু গলাচিপা নয় বরিশাল বিভাগের প্রায় সবগুলো জেলায় এভাবে গড়ে উঠেছে তরমুজের মোকাম। অনেকে ভালো দামের আশায় তরমুজ নিয়ে আসছেন বরিশাল পোর্ট রোড আড়তে। অনেকে দাদন শোধ করার জন্য বাধ্য হয়ে আসছেন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চাষি জাকির হোসেন বলেন, পারিবারিকভাবেই আমাদের ব্যাবসা তরমুজ চাষ। পাঁচ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। কিছু দাদন ছিল বিধায় বরিশালে এসেছি। নয়তো ভোলা থেকে পটুয়াখালীর যে কোনো উপজেলায় গিয়া বিক্রি করে দিতাম। ওখানে ভালো পাইকার পাওয়া যায়। এখনো মৌসুমের তরমুজ তোলা শুরু হয়নি। আগাম জাতের তরমুজে বেশ দাম পাচ্ছি। ঝড়-বন্যা না হলে এবার লাভ হবে।  পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কালাইয়া থেকে এসেছেন আরেক চাষি শাহ আলম। তিনি বলেন, গত বছর ঝড়-বন্যাছাড়াই তরমুজ গাছ মরে গিয়েছিল। এ বছর গাছ ভালো ছিল, ফলনও ভালো হয়েছে। ৮ হাজার পিস তরমুজ নিয়ে এসেছি। ১৬ থেকে ২৪ হাজার টাকা দামে বিক্রি করেছি। অর্থাৎ আকার অনুসারে প্রতি ১০০ পিস তরমুজ ১৬ থেকে ২৪ হাজার টাকা দামে বিক্রি করেছি।

এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৬ হাজার ২০৭ হেক্টর জমিতে চাষ বেশি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল। ২০২৩-২৪ মৌসুমে বরিশাল বিভাগে আবাদ হয়েছিল ৪৮ হাজার ৪৭ হেক্টর জমি। চলতি মৌসুমে (২০২৪-২৫) চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৫৪ হাজার ৫৫১ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে আবাদের হার নির্ণীত হয়েছে ১১২.৪৭ শতাংশ।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এস এম মাহবুব আলম বলেন, এখন যে তরমুজ বাজারে এসেছে এটা আগাম জাতের তরমুজ। মূল লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে এই তরমুজের হিসাব আমরা ধরবো না। তবে আগাম এবং মৌসুমের তরমুজ ফলন ভালো হয়েছে। আমরা ধারণা করছি চলতি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজে ৪০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। তিনি বলেন, তরমুজ দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ শস্য। খুব স্বল্প সময়ে তরমুজের মৌসুম শেষ হয়ে যায়। এমনকি খেত থেকে তোলার পরে বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। যদি তেমন কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হতো তাহলে আরও বাণিজ্যিক সফলতা আসার সম্ভাবনা ছিল।

আড়তদার, চাষি ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাজারে আসতে শুরু করে তরমুজ। মে মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যেতে পারে। ফলন ভালো হলেও খুচরা বাজারে এখনো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে তরমুজ। দামের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে খুচরা বিক্রেতা ও আড়তদার পরস্পরকে দোষারোপ করেন। নগরীর বান্দ রোডের খুচরা বিক্রেতা কবির হোসেন বলেন, চাষিদের কাছ থেকে অল্প দামে কিনলেও অতি উচ্চ দামে আড়ৎদাররা তরমুজ বিক্রি করেন। আমরা বেশি দাম দিয়ে কিনছি তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।

বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশাল পোর্ট রোড মোকামে তরমুজ কিনতে এসেছেন মিরাজ ঢালী। আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ৪০০ তরমুজ কিনতে এসেছিলাম। আড়তে আড়তে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছি। চোখের সামনে কৃষকের কাছ থেকে যে তরমুজ ৯ হাজার টাকায় কিনে রেখেছে। আড়তে তুলে রাখার পরই তা ১৩ হাজার টাকা চাইছে। ১২ হাজার পর্যন্ত বলেছি। দেয়নি। তরমুজের দাম বাড়ায় আড়তদার সিন্ডিকেট। নাটোর থেকে আসা আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, গতকাল থেকে আড়তে ঘুরছি। খুব বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে এ বছর। এখনো তরমুজ কিনতে পারিনি। সরকার আড়তদারদের নিয়ন্ত্রণ না করলে তরমুজের বাজার নষ্ট হয়ে যাবে।

যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে আড়তদার ইমন বলেন, আমরা চাষিদের সঙ্গে কমিশনে ব্যবসা করি। দাম বৃদ্ধি কমানোর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। খুচরা বিক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে পিস হিসেবে কিনে কেজি দরের হিসেবে বিক্রি করেন। যার কাছ থেকে যা রেখে পারেন, এমন নীতিতে তরমুজের দাম বাড়ায়। আরেক আড়তদার সুজন বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের ওপর আড়ৎদারদের কোনো হাত নেই। ক্রেতাদের ঠকিয়ে অল্পতে বেশি লাভ করতে চায় খুচরা বিক্রেতারা। এজন্য তারা দামের অস্থিরতা তৈরি করছে।

মৌসুমের আগেই আগাম জাতের তরমুজের ভালো মূল্য ইতিবাচক বলে মনে করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উদ্যান বিশেষজ্ঞ জিএমএম কবীর খান। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের সোনালি শস্য হচ্ছে তরমুজ। সারা দেশের দুই তৃতীয়াংশ তরমুজ উৎপাদন হয় এই বিভাগে। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই অর্থকরী ফসলের চাষিদের পাশে রয়েছে। আমরা চাই কৃষক লাভবান হোক। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, অনেক কৃষক বাজার সিন্ডকেটের কারণে চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। এমন অনেক কৃষক আমাকে জানিয়েছেন, মধ্যস্বত্ত্বভোগী বিশেষ করে আড়ৎদারদের সিন্ডিকেটের কবলে পরে ভালো ফলন হলেও তারা মুনাফা তুলতে পারেনি। আমি মনে করি, বাজার ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো তারতম্য হচ্ছে কিনা তা দেখা দরকার।


বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ